কীসের যৌক্তিকতায় বন্ধ হচ্ছে ভিওএ বাংলা বেতার সম্প্রচার?

দুঃখজনকভাবে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের বৃহৎ আন্তর্জাতিক সম্প্রচার মাধ্যম ভয়েস অব আমেরিকা (ভিওএ), যা ১৯৪২ সাল থেকে ৪৫টি ভাষায় সপ্তাহে স্যাটালাইট, ক্যাবল, এফএম ও মিডিয়াম ওয়েভে আড়াই হাজারেরও বেশি নেটওয়ার্ক স্টেশনের মাধ্যমে ২৮ কোটি মানুষের কাছে পৌঁছায়, তা ১৩ জুলাই, ২০২১ পরিবেশিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে তাদের অতি সমৃদ্ধ বাংলা বেতার সম্প্রচার বন্ধ করতে যাচ্ছে বলে জানিয়েছে। 

নিঃসন্দেহে সে সংবাদ অনেককেই বেদনাহত-বিমূঢ় করেছে, যেমনটা এখন কানাডায় থাকলেও বাংলাদেশে এক সময় ভিওএ ফ্যান ক্লাবের সভাপতি থাকায় আমি তা অনুভব করছি। তার কারণটি স্বচ্ছ, সহজ ও জোরালো; কেননা বাংলা বিশ্বে বহুল ব্যবহৃত ১০০টি ভাষার মাঝে সপ্তম, যার বুৎপত্তি ইন্দো-অ্যারিয়ান ভাষা থেকে বিস্তৃত এবং বিশ্বে ২২ কোটি ৮০ লাখেরও বেশি মানুষ সে ভাষায় কথা বলে।

এখন যে কেউ ওই দৃষ্টিকোণে ‘ভিওএ বাংলা সার্ভিস তার বেতার সম্প্রচারের ইতি টানছে, বাড়াবে টিভি ও সামাজিক মাধ্যমের পরিধি’ শীর্ষক পরিবেশিত সংবাদ বিজ্ঞপ্তিটি পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করতে পারেন। তাতে শুরুতেই বলা হয়েছে, ‘৬৩ বছর বাংলাদেশ ও বাংলাভাষী ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা ও আসামে সম্প্রচারের পর আনুষ্ঠানিকভাবে ২০২১ সালের ১৭ জুলাই ভয়েস অব আমেরিকা বাংলা বিভাগের এফএম ও শর্টওয়েভ ট্রান্সমিশন বন্ধ হতে যাচ্ছে। একই সঙ্গে তুলনামূলক ওই বিভাগের টেলিভিশন ও সামাজিক মাধ্যমের বিষয়বস্তু বৃদ্ধি পাবে, কেননা ভিওএ বাংলার সাপ্তাহিক ১ কোটি ৬০ দর্শক-শ্রোতা অতিমাত্রায় ওই প্ল্যাটফর্মটি ব্যবহার করছেন।’

এরপরই ৬৩ বছরের গুরুত্বারোপে ভারপ্রাপ্ত ভিওএ অনুষ্ঠান পরিচালক জন লিপম্যানের উদ্ধৃতিতে বলা হয়েছে: ‘১৯৫৮ সালের জানুয়ারিতে যখন ভিওএ বাংলার প্রচলন ঘটে, বাংলাদেশের পরিচিতিটি ছিল ‘পূর্ব পাকিস্তান’ এবং তা টেলিভিশন ও ব্যক্তিমালিকানাধীন বেতারহীন মার্শাল ল’ কবলিত অঞ্চল। সীমান্তের বাইরে থেকে ভিওএ’র শর্টওয়েভ বেতার সম্প্রচারটি ছিল বাংলাভাষী জনগোষ্ঠির জন্য সংবাদ ও তথ্যের স্বাধীন প্রানসংযোগ।’

কিন্তু সেই ‘প্রানসংযোগটি’ পরক্ষণই বিতাড়ন করে বলা হয়েছে: ‘এখন যখন বিভাগটির শর্টওয়েভ বেতার শ্রোতা ১ শতাংশের নিচে নেমে এসেছে, তখন সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ভিওএ বাংলা সামাজিক মাধ্যমের দর্শক-শ্রোতা আশাতীত বেড়েছে। গত বছর টুইটার অ্যাকাউন্টে ৫৪ শতাংশ এবং একই সময়ে ইনস্টাগ্রামে বেড়েছে ২৭৪ শতাংশ। কারণ, ওই তুলনাচিত্রের কোনো ভিত্তি নেই, বলা হয়নি কারা সেই টুইটার ও ইনস্টাগ্রাম ব্যবহারকারী?

অবশ্যই তারা আমেরিকার কন্ঠ বা আমেরিকান জনগণের কোনো সাধারণ শ্রোতা নয়, বাদ থাকুক তলানীতে যাওয়া ‘শর্টওয়েভ বেতার শ্রোতা ১ শতাংশের নিচে নেমে আসা’! কেন তা হলে ওই অঞ্চলের কবওয়েবে মিডিয়াম ওয়েভের সম্প্রচারটি বন্ধ করা হলো?

তথাপি আবারও জন লিপম্যানের উদ্ধৃতিতে বলা হলো: ‘বাংলাভাষী দর্শক-শ্রোতার মনজয়ের প্রতিযোগিতায় নেমেছে কয়েক ডজন টেলিভিশন ও বেতার, এমনকী বাড়ছে ডিজিটাল উৎস।

বাংলাদেশে টেলিভিশন ও অনলাইন সংবাদ প্রাপ্তির চাহিদা বিস্তৃত হওয়ায় কার্যকর ভিওএ বাংলা অনুষ্ঠান পরিবেশনার দর্শক-শ্রোতাই সেজন্য বিবেচ্য।’ নিঃসন্দেহে তাতে ‘অনলাইন সংবাদ প্রাপ্তির’ অপরিহার্যতাটি যথার্থ, কিন্তু সেটা তো ‘পডকাস্ট’ করেও পরিপূরণ করা যেত; সেজন্য বাংলা সম্প্রচারটি কী পুরোপুরি তিরোহিত করতে হবে?

ওই বিজ্ঞপ্তিতে আরও সকলকে দুঃখজনকভাবে বোকা বানানো হয়েছে! এতে বাংলাদেশ উল্লেখবিহীন ১৯৫৮ সাল থেকে অনুষ্ঠান প্রচারনার প্রতি ফিরে দেখায় ভারপ্রাপ্ত ভিওএ বাংলা বিভাগের প্রধান শতরূপা বড়–য়ার উদ্ধৃতিতে বলা হয়েছে: ‘প্রাথমিক সংবাদ মাধ্যমের শুরু থেকে ভিওএ বাংলা বেতার প্রচারনা শ্রোতাদের কাছে বিশ্বের ঘটনাবলীকে তুলে ধরেছে। এটাই ছিল নিয়ামক অনুষঙ্গ, ঘরে ঘরে প্রচারিত নাম। আমরা সেই সুখ্যাতিটি গণমাধ্যমে বিনির্মাণ করবো, যেহেতু শর্টওয়েভ ও মিডিয়াম ওয়েভ বেতারের পরিবর্তে সেটাতেই মানুষ অতিমাত্রায় ঝুঁকেছে। কারণ, বাংলাদেশে আমাদের পরিষেবার ইতিহাসটি হচ্ছে, আমাদের অনেকের জন্যই ভিওএ-তে কাজ করা ছিল ‘স্বপ্নতুল্য পেশা’। আমরা সেই পরিবর্তনের ধারায় তা ধরে রাখবো।’ অবশ্যই সেই ‘স্বপ্নতুল্য পেশা’ জলাঞ্জলিত কিংবা হীন্যতায় পর্যবসিত হবার নয়, যারা অব্যাহতভাবে নিজেদের আত্মনিয়োগ করেছেন, যা আজকের প্রধানের যোগ্যতার ক্ষেত্রেও সমানভাবে প্রযোজ্য।

ওই সংবাদ বিজ্ঞপ্তিটি শেষটায় অভিপ্রায়ের অস্পষ্টতায় বলেছে, ‘এই পরিবর্তন বেতার সম্প্রচারে ‘প্রানসংযোগের’ ক্ষেত্রে কোনো বিরূপ প্রভাব ফেলবে না, যেহেতু মায়ানমার থেকে জাতিগত সহিংসতায় বাংলাদেশে পালিয়ে আসা মুসলিম উদ্বাস্তু রোহিঙ্গাদের ভাষায় প্রাত্যহিক ৩০-মিনিটের একটি বেতার অনুষ্ঠান করবে। এটি ২০১৯ সালের জুলাইয়ে চালু হওয়া বাংলা বিভাগেরই অনুষ্ঠান।’ বোঝা গেল, এখানেও শুরুতে বলা ‘প্রানসংযোগ’টি মুখ্য প্রতিপাদ্য হয়েছে। এতে কী করে ভিওএ ভেবেছে বাংলার পরিবর্তে রোহিঙ্গা ভাষাটি উপযোগী, যেখানে বাংলাভাষীরাই তাদের জন্মভূমিতে আবাসনের জায়গাটি করে দিয়েছে?

নাকি এখানেও জর্জ সরসের অভিলাষ পূরণের আকাঙ্খাটি বিমূর্ত, যিনি নিজেকে সহৃদয় ‘রোহিঙ্গা’ বলেন থাকেন এবং তার অর্থের প্রাচুর্য, বিনিয়োগ ও উপঢৌকণ পূর্ব ইউরোপের প্রাক্-সোভিয়েত রাষ্ট্রসমূহে ও মধ্য এশিয়ায় এক অদ্ভুত পন্থায় আপন বিদেশনীতি প্রণয়ন করেছে?

পরিশেষে তাই স্বজাত্যাভিমানে বলা প্রয়োজন, আমার ৪০ বছরের সাংবাদিকতার উৎকর্ষে নানাবিধ আন্তর্জাতিক বেতার সম্প্রচার মাধ্যমের মাঝে ভিওএ বাংলা ছিল সবার শীর্ষে এবং সেটির বেতার সম্প্রচারক ইশতিয়াক আহমেদ, ইকবাল আহমেদ, ইকবাল বাহার চৌধুরী, রোকেয়া হায়দার, কাফি খান, সরকার কবীর উদ্দীন, সৈয়দ জিয়াউর রহমান, মাসুমা খাতুন ফাহমি, ড. অসীম চক্রবর্তী, সুমন চট্টোপাধ্যায়, রমেন পাইন প্রমুখ। সে কারণে আমি বিশ্বাস করি, রেডিও হচ্ছে দূরজয়ী রাজা, বিশেষ করে বাংলাদেশে ও সর্বত্র, এমনকী ভ্রান্তিতে জড়িয়ে থাকা সামাজিক মাধ্যমের অপ্রতিরোধ্য উত্থানে। তথাপি নেলসনের ২০১৬ সালের অডিয়েন্স রিপোর্টে বলা হয়েছে, ‘বেতার সর্বত্র পৌঁছার মাধ্যম, ৯৩ শতাংশ ১৮ ঊর্ধ্ব বয়সী আমেরিকান প্রতি সপ্তাহে এএম/এফএম শোনেন এবং তার সংখ্যা প্রতি মাসে ২৪ কোটি ৩০ লাখ।’ স্বভাবতই তা বিস্ময়কর, কিন্তু তা টেলিভিশনের মতোই একীভূতহীন। সেজন্য বেতার সম্প্রচার বন্ধের আগে চাই সতর্ক বিচার-বিশ্লেষণ, যাতে শ্রোতা-দর্শকের চাহিদাটি পূরণ হয়।

Logo of VOA Bangla Service logo taken from VOA Bangla Facebook